সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোয় বিস্ফোরণে দগ্ধের আটদিন পর ফায়ার সার্ভিসকর্মী গাউসুল আজম (২৬) মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবরে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার খাটুয়াডাঙ্গা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাচ্ছেন মা আছিয়া বেগম। আর গাউসুলের স্ত্রী কাকলী বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। রোববার (১২ জুন) ভোরে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন গাউসুল মারা গেছেন।
তিনি উপজেলার খাটুয়াডাঙ্গা গ্রামের আজগর আলীর ছেলে।দুই ভাইবোনের মধ্যে গাউসুল ছোট। ২০১৬ সালে খাটুয়াডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১৮ সালে ফায়ার সার্ভিসের যোগ দেন। এরপর একই ইউনিয়নের কাজীয়াডা গ্রামের কাকলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
দুপুরে খাটুয়াডাঙ্গা গ্রামে গাউসুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে স্বজনদের মাঝে বসে বিলাপ করছেন মা আছিয়া বেগম। একটু পর পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তিনি। বাবাও কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করছেন। আর গাউসুলের স্ত্রী কাকলী যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। তাদের ছয় মাস বয়সী ছেলে সিয়াম চাচার কোলে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বজনরা কাঁদছেন।
একমাত্র ছেলে ফায়ারম্যান গাউসুলের মা আছিয়া বেগম বুক চাপড়াচ্ছেন আর বিলাপ করে বলছেন, ‘আল্লাহ তুমি আমার কী পরীক্ষা নিলে; একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নিলে। এখন আমি কারে নিয়ে বাঁচবো। কত স্বপ্ন ছিল ওর ছেলেরে নিয়ে। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল রে আল্লাহ। আমারে নিয়ে তুমি আমার গাউসুলরে ফিরাইয়া দাও আল্লাহ।’পাশেই গাউসুলের স্ত্রীকে ধরে বসে আছেন প্রতিবেশী ও স্বজনরা। কাঁদতে কাঁদতে যেন তার চোখের জল সব শেষ! নির্বাক কাকলী দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। কোনোই কথা বলতে পারছেন না তিনি।
খাটুয়াডাঙ্গা গ্রামে গাউসুলের বাড়ির পাশের সুপারি বাগানে তার কবর খনন করা হচ্ছিল। কবরের পাশে কাঁদছিলেন বাবা আজগর আলী। আর্তনাদ করে বলছিলেন, ‘ওরে গাউসুল…রে। তুই আমাগের ফেলে রেখে চলে গেলি। তোর ছয়মাস বয়সী ছেলে আর বউয়ের দিকে তাকাতি পারছি নে। ও আল্লাহ রে…তুমি আমার গাউসুলরে সুস্থ করে না দিয়ে কেড়ে নিলে। আমি এখন কারে নিয়ে বাঁচবো!’গাউসুলের মামাতো ভাই রমজান আলী বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে বাড়ির কারও চোখে ঘুম নেই। সবাই দুশ্চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে ভোর ৪টার দিকে খবর আসে, ভাই মারা গেছেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন গাউসুল ভাই। মামার চাষের জমিও নেই। কীভাবে যে এখন তাদের সংসার চলবে, আল্লাহ জানেন।
খাটুয়াডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হজরত আলী বলেন, গাউসুল খুব ভালো ছাত্র ছিল। সাহসও ছিল অনেক। অল্প কিছুদিনের চাকরিতে সে বীরযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এরই মধ্যে ছেলেটি মারা গেলো।চাচা আকবর আলী বলেন, মাস দুয়েক হলো গাউসুল সীতাকুণ্ডে বদলি হয়েছে। এর আগে বাগেরহাটে ছিল। তখন প্রায়ই বাড়ি আসতো। এরপর ছয় মাসের জন্য তাকে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়।তিনি আরও বলেন, ঢাকায় ময়নাতদন্ত হয়ে গেছে। সেখান থেকে গোসল করিয়ে মরদেহ ফায়ার সার্ভিসের হেড অফিসে নিয়ে যায়। ঢাকায় জানাজা শেষে তাকে যশোরে আনা হচ্ছে।
গত ৪ জুন সীতাকুণ্ডে উপজেলার কদমরসুল এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণের সময় বিস্ফোরণ ঘটলে আহত হন ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ দুই শতাধিক মানুষ। এ ঘটনায় গাউসুল আজমসহ এখন পর্যন্ত ১০ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হলো। আর সবমিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৮ জনে।