সন্তানের বাবা হবেন, এ কথা মৃত্যুর আগে স্ত্রীকে ঘনঘন বলতেন উৎপল

স্বামী উৎপল সরকার কে হারিয়ে শূন্যতায় স্ত্রী বিউটি রানী নন্দী। একজন ভালো মানুষ, শিক্ষক ও বন্ধুতুল্য স্বামীকে অকালে হারিয়েছেন স্ত্রী বিউটি রানী নন্দী। মহান পেশায় নিয়োজিত তার স্বামী শিক্ষক উৎপলকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই শিক্ষার্থী।

এমন ঘটনা যেন মেনেই নিতে পারছেন না স্ত্রী বিউটি। আজ তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীর দিন স্বামীকে কাছে না পেয়ে নিঃসঙ্গতায় দিন কাটছে তার। নিঃসঙ্গতা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়েই বারবার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে তার। তারপরও বলতে থাকেন ক’দিন আগেও তাকে দেয়া স্বামীর কথাগুলো।গত শনিবার সাভারের আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুছ আলী কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে আহত করার একদিন পর হাসতাপাতালে তার মৃত্যু হয়। শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতু সবার সামনে তার স্বামী উৎপলকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এমনটাই দাবি স্ত্রী বিউটি রানীর।

২০১৯ সালের ৩০ জুন পারিবারিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন বিউটি রানী নন্দী ও উৎপল কুমার সরকার। করোনার কারণে বিয়েতে তেমন আয়োজন হয়নি। তবে আজ তাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী সবাইকে নিয়ে আনন্দ করে পালন করার কথা জানিয়েছিল উৎপল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও প্রিয় শিক্ষার্থীদের অনেককেই দাওয়াত দিয়েছিল সে।

নিহতের স্ত্রী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পার্সোনাল অফিসার বিউটি রানী নন্দী। তিনি বলেন, বিয়ের সময় করোনার কারণে সেভাবে আয়োজন করা হয়নি। দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীতেও আমি ছিলাম মিরপুরে আর ও ছিলো জামগড়ায়। তখনও করোনার প্রকোপের কারণে ঘর থেকে বের হতে পারিনি। গত নভেম্বর থেকে আমরা দুজনে মিরপুর আনছার ক্যাম্পে ভাড়া বাসায় উঠেছি। সবে সংসারটা গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। কারণ বিয়ের পর থেকেই ও (উৎপল) জামগড়ায় দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকত। আমি মাঝে মাঝে ওখানে যেতাম। আজ ৩০ জুন আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে সবাইকে নিয়ে পালন করতে চেয়েছিলাম। ওর বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী এমনকি শিক্ষার্থীদেরও দাওয়াত করেছিল। এই বারেই প্রথম একটু জাকজমক করে বিবাহ বার্ষিকীটা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটাও হলো না। ওর শখটাই বেশি ছিলো। অনেকদিন ধরেই বলতেছিল। গত বছরও পালন করতে চেয়েছিল কিন্তু তখনও করোনার কারণে হয়নি। ইদানিং মাস খানেক একটা কথা বলত, সুন্দর ভাবে সংসার করবে। বাচ্চার বাবা হবে। তাকে বাবা বলে ডাকবে। এই কষ্ট আমি কাকে বোঝাব? কিন্তু আজ ও আমার কাছে নেই।

‘আমি এখন কি করব বুঝতে পারছি না। দিশেহারা অবস্থায় আছি। বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন কল্পণা যখন করছি তখনই ওকে মনে হচ্ছে। ওর অনেক প্রয়োজন সেটা অনুভব করছি। ওর অভাবটা আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। কোন কাজ করতে গেলেই ওকে আমার পাশে দরকার। আমি শূণ্য অবস্থায় আছি। বাসায় কোন কাজ করলে ওর পরামর্শ নিয়ে করতাম। ওকে ছাড়া কোন কাজই আমি সম্পূর্ণ করতে পারছি না।’ঢাকা জেলা অঞ্চলের কথা চিন্তা করে স্বামী উৎপলকে ওই কলেজে পরিবেশ কমিটিতর না থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানান স্ত্রী বিউটি। কিন্তু কলেজ থেকে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানিয়ে স্ত্রীর কথা শোনেননি উৎপল।

স্বামীর কথা উল্লেখ করে বিউটি রানী বলেন, কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রেমের বিষয় গুলো নিয়েই বেশি আলোচনা হতো। এসব সমাধার করতো। শিক্ষার্থীরা তাকে ভয় পেত সেই কথাও বলেছিল আমাকে। তবে তাকে মেরে ফেলতে পারে এমন বড় কোন বিষয় জানায়নি।নিহত শিক্ষকের বড় ভাই অসীম কুমার বলেন, আমরা পরিবারের সবাই একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। মা পাগলের মতো হয়ে গেছে। উৎপলের স্ত্রী এখন আমাদের বাড়িতে সিরাজগঞ্জে আছে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তিন বছর আগে করোনার কারণে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানটাও ঠিকভাবে করা হয়নি। উৎপল বলেছিল, আজকে আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠান করবে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আজ সবাই আছে, কিন্তু আমার ভাই আর নেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১০ বছর ধরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করছিলেন উৎপল কুমার সরকার। এই প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ কমিটির সভাপতিও ছিলেন।প্রসঙ্গত, গত শনিবার দুপুরে কলেজ মাঠে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালীন সময়ে শিক্ষক উৎপল কুমারকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করে একই প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণীর ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু। পরদিন রোববার সকালে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। একই দিন নিহতের বড় ভাই অসীম কুমার আশুলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে বুধবার কুষ্টিয়ার কুমারখালি থেকে অভিযুক্ত জিতুর বাবা উজ্জ্বল হোসেনকে আটক করে পুলিশ।

ওই মামলায় তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। একই দিন রাতেই গাজীপুর থেকে মামলার প্রধান আসামি জিতুকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।আশরাফুল ইসলাম জিতুকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে আশুলিয়া থানা পুলিশ জিতুকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে প্রেরণ করে। পরে আদালতে তোলা হলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক রাজিব হাসান।