‘তুমি যখন কাউকে ভালো বাসবে, এক বুক সমুদ্র নিয়ে তাকে ভালো বাসবে। তা নাহলে প্রেমের কোন অর্থ নাই।’
ভালোবাসা নিয়ে প্রখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির করা উক্তিটি আজ সবার মাঝে থাকলেও সেই মানুষটি আজ নেই।সমুদ্রের মতো ভালোবাসা অর্জন করে ৯ বছর আগে হুট করে চলে গেছেন অভিনয়ের এই বাতিঘর।
গত ২৯ মে হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন ছিল। ১৯৫২ সালের ঐ দিনে ঢাকার নারিন্দায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র- তিন মাধ্যমেই ছিল তার সমান পদচারণা।
তিন দশকের বর্ণিল ক্যারিয়ারে তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক জনপ্রিয় নাটক ও চলচ্চিত্র।জন্ম ঢাকায় হলেও শৈশব-কৈশোরে বাবার চাকরির সুবাদে ঘুরতে হয়েছে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ আরও অনেক জেলায়।
প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্কুলে। চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন ১৯৭০ সালে।
এরপর একই বছর স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়ন বিভাগে।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে অনার্স সম্পন্ন করেন।
এরপর পেশা হিসেবে বেছে নেন অভিনয়। যদিও ছাত্রজীবন থেকেই মঞ্চ নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জে মহল্লার একটি নাটকে অভিনয় করে তার অভিষেক হয়।
স্কুল জীবনেই ‘ভূত’নাটকে নির্দেশনা। এরপর ঢাকার মঞ্চে ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘ফণীমনসা’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকগুলোতে তার অভিনয় কেবল প্রসংসিতই হয়নি, হুমায়ুন ফরীদিকে করে তুলেছে অনন্য।
টেলিভিশন কিংবা মঞ্চে সেলিম আল দীন এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গেই ছিল এ অভিনেতার সর্বাধিক সংখ্যক কাজ। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গেও অনেক নাটকে কাজ করেছেন হুমায়ুন ফরীদি।
বিশেষ করে হুমায়ুন আহমেদের ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিক নাটকে হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত চরিত্র ‘কানকাটা রমজান’এখনও দর্শকমনে দাগ কেটে আছে।চলচ্চিত্রেও হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে খলচরিত্রে তার অনবদ্য অভিনয় এখনও দর্শকচোখে তৃপ্তি জুড়ায়।
‘মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ২০০৪ সালে সেরা অভিনেতা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান এ অভিনেতা।২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট মুক্তি পাওয়া উত্তম আকাশ পরিচালিত ‘এক জবানের জমিদার, হেরে গেলেন এবার’ ছিল তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র।অভিনয় করলেও লেখালেখির প্রতি তেমন কোনো দুর্বলতা ছিল না হুমায়ুন ফরীদির।
নির্মাণের প্রতি আগ্রহ থাকলেও অভিনয় ব্যস্ততার কারণে সেখানেও খুব বেশি দেখা যায়নি তাকে। তবে কয়েকটি টেলিফিল্ম, ধারাবাহিক ও এক ঘণ্টার নাটক নির্মাণ করেছেন এ অভিনেতা।
ব্যক্তিজীবনে বেশ সাদামাটা মানুষ ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। এরপর প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে ঘর বাঁধেন এ অভিনেতা। কিন্তু ২০০৮ সালে তাদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর থেকে ২০১২ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একাই দিনযাপন করেছেন প্রখ্যাত এ অভিনেতা।
হুমায় ফরিদি তার মৃত্যুর এক বছর আগে বাংলাদেশের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে নিয়ে করে গিয়েছিলেন এক অসাধারন উক্তি যা আমরা অনেকেই আজ ভুলে গেছি। সময়টি ছিল ২০১১ বিশ্বকাপ চলাকালীন, পত্রিকায় সাকিব আল হাসান তার কলামে সাবেক খেলোয়াড়দের এবং দর্শকদের সমালোচনা করেছিলেন।
কাজী সাবির তখন বাংলাভিশনে বিশ্বকাপ নিয়ে একটা ডেইলি শো হোস্ট করি। বয়স কম ছিল, সাকিবকে নিয়ে মনে যা আসলো বলে গেলাম শো’তে। ভাগ্য ভাল সোশাল মিডিয়ার যুগ ছিল না।পরের দিন হুমায়ুন ফরীদি আমাকে বললেন, ‘তোমার শো দেখলাম, সাকিবকে নিয়ে এইভাবে তোমার বলা ঠিক হয় নাই!’
আমি নিজের পক্ষে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করলাম। উনি বলেছিলেন- ‘শোনো, সাকিব এত প্রতিভাধর যে ওকে বুঝার ক্ষমতা এখনও তোমার হয় নাই।তোমাদের মনে হয় ওর মধ্যে কোন বিনয় নেই।
বিনয় না থাকলে এত বড় জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব না। কখনো যদি ওই জায়গায় পৌঁছাতে পারো তাহলে বুঝবা, সাকিবের বিনয়টা কোথায়!আমি উত্তরে বলেছিলাম- ‘তাহলে তো আমি কোনদিনও সাকিবকে বুঝতে পারবো না।’ এরপর ওনার সেই বিখ্যাত দরাজ হাসি। তিনি ক্রিকেট অনেক ভালো বুঝতেন, ভালবাসতেন, আর খেলোয়াড়দের অনেক সম্মান করতেন।